বেজিং চায় নেপালে বামেরা বিজয়ী হোক, যাতে চিন তাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে পারে এবং নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য চাপ দিতে পারে

নেপালের সাম্প্রতিক নির্বাচনকে চিনারা নিবিড়ভাবে অনুসরণ করছে। গত কয়েক মাসে চিন নেপালের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের আদানপ্রদান করেছে। ২০২২ সালের মার্চ মাসে নেপালের পার্লামেন্ট বহুল আলোচিত ইউনাইটেড স্টেটস মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন (এমসিসি) কমপ্যাক্ট অনুমোদন করার কয়েকদিন পর চিনা বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই কাঠমান্ডুতে রাষ্ট্রীয় সফর করেন। সেই সময় নেপালের জন্য চিনের ‘তিনটি সমর্থন’ সম্পর্কে তিনি ব্যাখ্যা দেন এইভাবে: ‘‘নিজের জাতীয় অবস্থার উপযোগী একটি উন্নয়নের পথ প্রজ্জ্বলিত করা … স্বাধীন দেশীয় ও বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করার পথ করে দেওয়া… এবং আরও বেশি পরিমাণে বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতায় অংশগ্রহণ করা।’’ এর পরে চিনা স্টেট কাউন্সিলর ও বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের আমন্ত্রণে নেপালের বিদেশমন্ত্রী নারায়ণ খাডকা গত ৯–১১ অগস্ট চিনে তিন দিনের সফরে যান, যেখানে ‘এক চিন’ নীতি এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ মুখ্য হয়ে ওঠে। ১২ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চিনের ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান লি ঝানশু নেপালে আনুষ্ঠানিক শুভেচ্ছা সফর করেন এবং প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারী, প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা ছাড়াও বিভিন্ন কমিউনিস্ট নেতার সঙ্গে দেখা করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন নেপাল–ইউনিফাইড মার্ক্সিস্ট লেনিনিস্ট কমিউনিস্ট পার্টির কে পি শর্মা ওলি, মাওবাদী পার্টির পুষ্প কমল দহল, এবং পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের প্রিসাইডিং অফিসারেরা (নেপাল হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস–এর স্পিকার অগ্নি প্রসাদ সাপকোটা ও নেপালিজ ফেডারেল হাউস–এর চেয়ারম্যান তিমির সিনা), যাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির লোক। অবশেষে নেপাল নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগে নেপালের অনাগ্রহ সত্ত্বেও চিনের সংস্কৃতি ও পর্যটন বিষয়ক উপমন্ত্রী লি কুনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল নেপালে পাঁচ দিনের সফরে এসেছিল।
চিনা স্টেট কাউন্সিলর ও বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের আমন্ত্রণে নেপালের বিদেশমন্ত্রী নারায়ণ খাডকা গত ৯–১১ অগস্ট চিনে তিন দিনের সফরে যান, যেখানে ‘এক চিন’ নীতি এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ মুখ্য হয়ে ওঠে।
চিনের কূটনৈতিক প্রয়াস
নেপালের প্রতি চিনের এই তীব্র কূটনৈতিক আগ্রহের ব্যাখ্যা কী? চিনা পণ্ডিতদের লেখাগুলি ইঙ্গিত করে ২০১৭ সালে যে চিন নেপালে কমিউনিস্ট জোট তৈরির মধ্যস্থতা করেছিল, তারা এখনও ২০২১ সালের মার্চ মাসে নেপালে কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল (সিপিএন) সরকারের পতনের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। চিনা কৌশলগত সম্প্রদায়ের অভিমত যে সাম্প্রদায়িকতা, উপযোগবাদের মতো অভ্যন্তরীণ কারণগুলি ছাড়াও একটি বাহ্যিক কারণ হিসাবে যা সিপিএনকে প্রথম থেকেই জর্জরিত করেছিল তা হল ইউএস–নেপাল মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ চুক্তি। এই চুক্তি অভ্যন্তরীণ লড়াইকে আরও তীব্র করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।[১]
চিনের অভিযোগ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে (ক্ষমতা বণ্টন, পথপ্রদর্শক আদর্শ, শাসন কৌশল ইত্যাদি) ব্যবহার করেছে এবং মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ চুক্তিটিকে ওলি গোষ্ঠী ও প্রচণ্ড গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও উস্কে দেওয়ার জন্য একটি উপকরণ হিসাবে কাজে লাগিয়েছে। এইভাবে তারা পার্টিকে বিভক্ত করে, এর শক্তিকে দুর্বল করে এবং নেপালে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে স্তিমিত করে দেয়[২]। নেপালের এত বড় ঘটনার বিষয়ে ভারতের কৌশলগত নীরবতাকে ব্যাখ্যা করা হয় এইভাবে যে এ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগসাজস এবং নেপালে চিনের বিরুদ্ধে মার্কিন শক্তির সঙ্গে হাত মেলানো। সামগ্রিকভাবে, চিনা পণ্ডিতরা সিপিএন–এর পতনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়ের জন্য একটি বড় জয় হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন[৩]।
চিন স্পষ্টতই নেপালে এমন একটি সর্বশক্তিমান কমিউনিস্ট শাসন চায় যে সিপিসি ও তার শাসন মডেলের প্রতিলিপি হবে এবং নেপালের সঙ্গে চিনের সম্পর্কের উন্নয়ন ও চিনা স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবে। চিনা পণ্ডিতেরা প্রায়শই মনে করিয়ে দেন যে ২০১৮ সালে সিপিএন ক্ষমতায় আসার পর থেকে চিন–নেপাল সম্পর্কের দ্রুত অগ্রগতি হয়েছিল, দুই দেশের মধ্যে উচ্চস্তরের সফর বেশি করে হয়েছে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা ক্রমশ এগিয়েছে [৪]। সিপিসি ও সিপিএন ঘন ঘন মতবিনিময় করেছে, এবং যৌথভাবে তাত্ত্বিক সেমিনার ও অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। অক্টোবর ২০১৯ সালে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নেপাল সফর করেছিলেন, যা দুই পক্ষ ও দুই দেশের মধ্যে ব্যাপক সহযোগিতার প্রচার করেছিল। অন্যদিকে, সিপিএন–এর অনুপ্রেরণায় নেপালের প্রতিনিধি পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে ১৩ জুন ২০২০ তারিখে সাংবিধানিক সংশোধনী পাস করে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের সঙ্গে নেপালের ভূখণ্ড নিয়ে বিরোধের তিনটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ–রাজনীতিতে চিনের জন্য একটি বড় জয় নিশ্চিত করে।[৫]
নেপালের এত বড় ঘটনার বিষয়ে ভারতের কৌশলগত নীরবতাকে ব্যাখ্যা করা হয় এইভাবে যে এ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগসাজস এবং নেপালে চিনের বিরুদ্ধে মার্কিন শক্তির সঙ্গে হাত মেলানো।
চিনা মূল্যায়নে সিপিএন–এর বিভাজন নেপালের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে একটি মাইলফলক, এবং নেপালের রাজনৈতিক পরিসরের পাশাপাশি চিন–নেপাল সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে[৬]। উদ্বেগের সঙ্গে এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে যে বিভাজনের প্রভাব শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের স্তরেই নয়, প্রাদেশিক ও স্থানীয় স্তরেও অনুভূত হয়েছিল। আগে সিপিএন–এর নিয়ন্ত্রণে থাকা ছয়টি প্রাদেশিক সরকার পুনর্গঠিত হয়, এবং কংগ্রেস পার্টি তিব্বত সীমান্তে অবস্থিত গন্ডকি ও কারনালির মতো প্রদেশগুলি সহ বিভিন্ন অঞ্চলে নিজেদের জমি মজবুত করে[৭]।
চিনা পণ্ডিতেরা বিশ্বাস করেন যে কংগ্রেস পার্টি ক্ষমতায় আসার পরেই নেপাল ধীরে ধীরে চিন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যেমন চিনে উদ্বেগের সঙ্গে এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে যে ক্ষমতায় আসার পরে দেউবা সরকার নেপাল–চিন সীমান্তের হুমলা জেলার সীমান্ত সমস্যা অধ্যয়ন করার জন্য এবং চিন সেখানে নেপালের জমি দখল করে রেখেছে কি না তা খতিয়ে দেখার জন্য একটি উচ্চ-পর্যায়ের কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।[৮] এর আগে সিপিএন সরকার কিন্তু এ বিষয়ে একটি বিবৃতি জারি করে বলেছিল যে চিন ও নেপালের মধ্যে সীমান্ত চিহ্নিত করা হয়েছে এবং তা নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। যাই হোক, কংগ্রেস পার্টি ক্ষমতায় আসার পর আবারও চিন–নেপাল সীমান্তে সম্ভাব্য ‘সমস্যা’ অধ্যয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করার ঘটনাটি স্পষ্টভাবে চিনা পক্ষকে বিচলিত করেছিল[৯]। দ্বিতীয়ত, চিন উদ্বিগ্ন নেপালে মার্কিন–ভারত আগ্রহের সম্মিলন নিয়ে, যা নেপালে চিনের বিআরআই–এর অগ্রগতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে তারা মনে করে। যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে এমসিসি চুক্তি বাস্তবায়িত হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নেপালে তার হস্তক্ষেপ বাড়ানোর জন্য অর্থনৈতিক সহায়তাকে ব্যবহার করতে পারে, ভারতের সঙ্গে মিলে চিন–নেপাল বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের গতি কমাতে নেপালকে প্রভাবিত করতে পারে, এবং নেপালের দক্ষিণ অংশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও নেপালের সহযোগিতা প্রকল্পগুলির জন্য অগ্রাধিকার আদায় করে নিতে পারে।[১০] তৃতীয়ত, চিনের উদ্বেগ হল যে নেপালে ভারতের সঙ্গে একত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলি ও জাপানের মতো অন্যান্য প্রধান শক্তির বড়সড় উপস্থিতি আপাত–সুপ্ত তিব্বতি আন্দোলনকে নতুন জীবন দিতে পারে[১১]। এর ফলে ভূমি–অবরুদ্ধ, অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত ও জনসংখ্যা হ্রাসের সমস্যাকীর্ণ তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলকে উন্মুক্ত করা এবং বিআরআই ব্যানারের অধীনে নেপালের মধ্যে দিয়ে জমজমাট ভারতীয় বাজারে প্রবেশের অধিকার পাওয়ার চিনা পরিকল্পনা আরও সমস্যাসঙ্কুল হয়ে উঠতে পারে।
নেপালে ভারতের সঙ্গে একত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলি ও জাপানের মতো অন্যান্য প্রধান শক্তির বড়সড় উপস্থিতি আপাত–সুপ্ত তিব্বতি আন্দোলনকে নতুন জীবন দিতে পারে।
তাই চিনা নীতি–নির্ধারকদের মধ্যে নেপালের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের, এবং বিশেষ করে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ ও নেপালের সঙ্গে তিব্বতের সীমান্ত অঞ্চলের নিরাপত্তাসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিনা স্বার্থের প্রতি নেপালকে দায়বদ্ধ করার জরুরি প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে। চিনের অপর একটি মূল লক্ষ্য হল ‘বামপন্থী’ জোটকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং ‘বামপন্থী’ রাজনৈতিক দলগুলোর শক্তি বৃদ্ধি করা। সেই উদ্দেশ্যে তারা বারবার নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (ইউনাইটেড মার্কসবাদী–লেনিনবাদী) ও নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী কেন্দ্র)–র কাছে আহ্বান জানাচ্ছে যাতে তারা প্রাদেশিক ও ফেডারেল নির্বাচনে আবারও ক্ষমতা অর্জনের জন্য সহযোগিতা করে এবং এভাবে, চিনাদের ভাষায়, নেপালে কমিউনিস্ট আন্দোলনের জোরদার বিকাশের পথ তৈরি করে।
[১] দাই ইয়ংহং, জি গুয়াংল, “尼美千禧年挑战协议对尼共及中尼关系的影响与应对[J].当代世界社会主义问题” (নেপালি কমিউনিস্ট পার্টি এবং চিন–নেপাল সম্পর্ক ও প্রতিক্রিয়ার উপর নেপাল–মার্কিন মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ চুক্তির প্রভাব), 2022(02):131-139. DOI: 10.16012/j.cnki.88375471.2022.02.016.
[২] উপরোক্ত
[৩] উপরোক্ত
[৪] উপরোক্ত
[৫] তাং জিন, ঝাং শুবিন “尼泊尔共产党合并失败的原因和教训” (নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির ব্যর্থ একীভূতকরণের কারণ ও শিক্ষা”, সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ। ২০২২, (০১)
[৬] উপরোক্ত
[৭] দাই ইয়ংহং, জি গুয়াংল, “尼美千禧年挑战协议对尼共及中尼关系的影响与应对[J].当代世界社会主义问题” (নেপালি কমিউনিস্ট পার্টি এবং চিন–নেপাল সম্পর্ক ও প্রতিক্রিয়ার উপর নেপাল–মার্কিন মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ চুক্তির প্রভাব), 2022(02):131-139. DOI: 10.16012/j.cnki.88375471.2022.02.016.
[৮] দাই ইয়ংহং, জি গুয়াংল, “尼美千禧年挑战协议对尼共及中尼关系的影响与应对[J].当代世界社会主义问题” (নেপালি কমিউনিস্ট পার্টি এবং চিন–নেপাল সম্পর্ক ও প্রতিক্রিয়ার উপর নেপাল–মার্কিন মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ চুক্তির প্রভাব), 2022(02):131-139.DOI:10.16012/j.cnki.88375471.2022.02.016.
[৯] উপরোক্ত
[১০] উপরোক্ত
[১১] জি গুয়াং-লি দাই ইয়ং-হং, “বর্ডার সিকিউরিটি কমিউনিটি: চায়না-নেপাল’স কোলাবোরেটিভ গভর্নেন্স অফ বর্ডার সিকিউরিটি”, জার্নাল অফ টিবেট ইউনিভার্সিটি। ২০২২(০১) পৃষ্ঠা: ২২৩-২৩১
মতামত লেখকের নিজস্ব।