বেজিং ও ইসলামাবাদের মধ্যে অটুট, লৌহদৃঢ় সম্পর্কের সমস্ত সঠিক বিবৃতি ও দাবির পরেও শরিফের সফরের খুব সামান্য সারবত্তা ছিল।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দুই দিনের সরকারি সফরে চিনে গেছিলেন। শি জিনপিং অক্টোবর মাসের শেষের দিকে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর শরিফই ছিলেন বেজিং সফরে যাওয়া প্রথম বিদেশি সরকার–প্রধান। এই সফরে শরিফ প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং ও শীর্ষ চিনা আইন–প্রণেতাগণ সহ অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উভয় পক্ষ অর্থনীতি, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, ই–কমার্স, ডিজিটাল অর্থনীতি, সংস্কৃতি, আইন প্রয়োগ এবং নিরাপত্তা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আন্তঃসরকারি সহযোগিতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
শরিফের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের সময় শি চিনের প্রতিবেশ–কূটনীতিতে পাকিস্তানের গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছিলেন, এবং বলেছিলেন যে দুটি দেশ ‘ভাল বন্ধু, ভাল অংশীদার ও ভাল ভাই’। তিনি যোগ করেন যে দু’দেশ ‘পরস্পরকে সমর্থন করেছে এবং এগিয়ে গেছে, এবং এইভাবে একটি লৌহদৃঢ় বন্ধুত্ব প্রদর্শন করেছে’। সেই সঙ্গেই তিনি বলেছিলেন চিন এখন ‘সর্বস্তরীয় কৌশলগত সহযোগিতার স্তরকে উন্নত করতে … এবং তাদের সব সময়ের কৌশলগত সহযোগিতা অংশীদারিতে নতুন অনুপ্রেরণা’ দিতে প্রস্তুত।
শরিফের সঙ্গে শি–র আলোচনায় চিন–পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) স্থান পেয়েছে। শি বলেছেন যে চিন ও পাকিস্তান সিপিইসি–র যৌথ সহযোগিতা কমিটির মাধ্যমে সিপিইসি উন্নয়নকে আরও ত্বরান্বিত করবে, ‘আরও দক্ষতা আনবে, এবং সিপিইসি–কে একটি উচ্চমানের বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতার উদাহরণে পরিণত করবে’। শি যোগ করেন যে এই অঞ্চলে আরও বেশি উন্নয়ন ও আন্তঃসংযোগ আনতে ‘গয়াদর বন্দরের জন্য সহায়ক পরিকাঠামো নির্মাণকে ত্বরান্বিত করা’ গুরুত্বপূর্ণ। চিন কীভাবে এমএল–১ (৯.৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের করাচি থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত একটি উচ্চগতির রেল প্রকল্প মেন লাইন–১) ও করাচি সার্কুলার রেলওয়ে প্রকল্প সহ বেশ কয়েকটি অভ্যন্তরীণ উন্নয়নমূলক প্রকল্পের উন্নয়ন ও আপগ্রেডিংকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, সে সম্পর্কেও শি বলেছেন।
শি বলেছেন যে চিন ও পাকিস্তান সিপিইসি–র যৌথ সহযোগিতা কমিটির মাধ্যমে সিপিইসি উন্নয়নকে আরও ত্বরান্বিত করবে, ‘আরও দক্ষতা আনবে, এবং সিপিইসি–কে একটি উচ্চমানের বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতার উদাহরণে পরিণত করবে’।
তাঁর দিক থেকে শরিফ ‘পাকিস্তানের বিদেশনীতি ও পাকিস্তানের জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিপ্রস্তর’ হিসাবে ‘চিনের সঙ্গে পাকিস্তানের সর্বকালের কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারি গভীর করার’ গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি ‘চিনকে আরও উল্লেখযোগ্য অর্জনের দিকে নিয়ে যেতে এবং বিশ্বের জন্য আরও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তৈরি করতে’ চিন এবং শি–র ‘অসাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির’ প্রতি তাঁর পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করেন। তিনি কোভিড–সম্পর্কিত সমস্ত সহায়তার পাশাপাশি বিধ্বংসী বন্যার পরে পাকিস্তানকে দেওয়া সহায়তার জন্য চিনকে ধন্যবাদ জানান। শরিফ বলেছেন যে পাকিস্তান শি–র গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ ও গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ–কে পূর্ণ সমর্থন দেয় এবং ‘পাকিস্তান–চিন বন্ধুত্ব অটুট’ থাকবে। শি–র মন ভরিয়ে দিয়ে শরিফ এক চিন নীতির প্রতি পাকিস্তানের দৃঢ় সমর্থন এবং তাইওয়ান, জিনজিয়াং, দক্ষিণ চিন সাগর, তিব্বত ও হংকং–সহ বেজিংয়ের মূল ইস্যুগুলিতে চিনের অবস্থানের প্রতি দৃঢ় সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন।
শরিফ তাঁর চিনা সমকক্ষ লি কেকিয়াং–এর সঙ্গেও দেখা করেন, যিনি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রকৃতি সম্পর্কে একই ধরনের অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেন। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেন যে চিন বন্দর, পরিবহণ, জ্বালানি, শিল্প ও সামাজিক জীবিকা সহ সমস্ত ক্ষেত্র জুড়ে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে পাকিস্তানের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত। তবে তিনি আরও বলেছেন, ‘‘পাকিস্তানের উচিত ‘পাকিস্তানে সমস্ত চিনা কর্মী, প্রকল্প ও প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য কর্ম পরিকল্পনা’র বর্ধিত সংস্করণে আলোচনা ও স্বাক্ষর করাকে একটি সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করা, এবং পাকিস্তানে সমস্ত চিনা কর্মী, প্রকল্প ও প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সর্বাত্মকভাবে প্রয়াসী হওয়া।”
সিপিইসি প্রকল্পে কাজ করা চিনা নাগরিকদের নিরাপত্তা বেশ কিছু দিন ধরেই চিনের কাছে উদ্বেগের বিষয়। সিপিইসি–র যে ১১ তম যৌথ সহযোগিতা কমিটি সম্প্রতি বৈঠকে বসেছিল, তারা সিপিইসি প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধাস্বরূপ উঠে আসা চিনা নাগরিকদের উপর হামলার ঘটনা রোধ করার জন্য পাকিস্তানের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির সক্ষমতা বাড়াতে সম্মত হয়েছে। বৈঠকের খসড়া মিনিটের উদ্ধৃতি দিয়ে মিডিয়া রিপোর্টে বলা হয়েছে যে ‘প্রকল্পে নিযুক্ত চিনাদের সমস্ত প্রকাশ্য চলাচলের সময় বুলেটপ্রুফ যান ব্যবহার করা হবে’। এমন কথাও বলা হয়েছে যে চিন পাকিস্তানকে ‘আধুনিক কৌশল ও মডিউল’ দিয়ে সজ্জিত করার জন্য ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষীদের পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করতে সহায়তা করছে।
সিপিইসি–র যে ১১ তম যৌথ সহযোগিতা কমিটি সম্প্রতি বৈঠকে বসেছিল, তারা সিপিইসি প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধাস্বরূপ উঠে আসা চিনা নাগরিকদের উপর হামলার ঘটনা রোধ করার জন্য পাকিস্তানের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির সক্ষমতা বাড়াতে সম্মত হয়েছে।
বেজিংয়ে অবস্থানকালে শরিফ চিনের শীর্ষ আইনপ্রণেতা লি ঝানশুর সঙ্গেও বৈঠক করেন। লি সিসিপি–র ২০তম জাতীয় কংগ্রেসের সমাপ্তির পরপরই শরিফের চিন সফরের প্রশংসা করেন, এবং এই ঘটনাকে ‘দুই দেশের মধ্যে বিশেষ বন্ধুত্বের’ লক্ষণ হিসাবে চিহ্নিত করেন। লি শরিফকে আশ্বস্ত করেছেন যে চিনের ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস পাকিস্তানি পার্লামেন্টের সঙ্গে সর্বস্তরে সহযোগিতা জোরদার করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে।
বাগাড়ম্বরের দিক থেকে দেখলে এই সফর সফল হয়েছে বলে মনে করা যায়। কিন্তু বেজিং ও ইসলামাবাদের মধ্যে অটুট, লৌহদৃঢ় সম্পর্কের সমস্ত সঠিক বিবৃতি ও দাবির পরেও শরিফের সফরে খুব সামান্য সারবত্তা ছিল। একজন বিশ্লেষক বলেছেন, ‘‘এই সফরটি ছিল অনেক শব্দ এবং সামান্য পদক্ষেপ, এবং বেশিরভাগই পাকিস্তান ও চিনের সব–আবহাওয়ার কৌশলগত অংশীদারি পুনরায় নিশ্চিত করার বিষয়ে।’’ পাকিস্তান তার বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য কিছুটা স্বস্তির আশা করে থাকলে বলতে হবে বেজিং চিনের কাছে পাকিস্তানের দেনা মাফ করেনি। পাকিস্তানি মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী, ইসলামাবাদ চিনকে ‘তার ৬.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর’ অনুরোধ করেছে, যা এখন থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে পরিশোধ করার কথা ছিল। এর মধ্যে চিনা বাণিজ্যিক ঋণের পরিমাণ ৩.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, আর বাকি ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হল নিরাপদ আমানত ঋণ। এই নিরাপদ আমানত ঋণের মূল্য ছিল ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, এবং চিন জুলাই মাসে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়েছে বলে জানা গেছে। উপরন্তু, পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক চিনা ঋণের ৯০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি চলতি অর্থবছরে পরিশোধ করতে হবে। এদিকে, পাকিস্তান একটি নতুন প্রস্তাব দিয়ে নতুন করে চিনা ঋণ চাইছে যাতে ২০২২–২৩ অর্থবছরে আসন্ন দ্বিপাক্ষিক ঋণ পরিশোধ করা যায়।
সাম্প্রতিক মিডিয়া রিপোর্ট অনুসারে, পাকিস্তান শ্বাস নেওয়ার কিছুটা সময় পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু তা ইসলামাবাদের আর্থিক বা ঋণ সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান করে না। অর্থমন্ত্রী ইসহাক দার মিডিয়াকে বলেন যে শরিফের চিন সফরের সময় ‘চিনা নেতৃত্ব ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সার্বভৌম ঋণের মেয়াদ বাড়ানো, ৩.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক ঋণের পুনরায় অর্থায়ন করার এবং মুদ্রার অদলবদল প্রায় ১.৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৃদ্ধি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে—৩০ বিলিয়ন ইউয়ান থেকে ৪০ বিলিয়ন ইউয়ান। সবটা মিলিয়ে দাঁড়িয়েছে মোট ৮.৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।”
পাকিস্তানি মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী, ইসলামাবাদ চিনকে ‘তার ৬.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর’ অনুরোধ করেছে, যা এখন থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে পরিশোধ করার কথা ছিল।
চিন ও পাকিস্তানের মধ্যে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়ে সফরের পর প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে ‘দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে আস্থা ও যোগাযোগ’–এর উপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিবৃতিতে তাদের শক্তিশালী কৌশলগত প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতাকে ‘এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, এবং দু’দেশের সামরিক বাহিনীর উচ্চস্তরের সংযোগ জোরদার করার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ, যৌথ মহড়া ও প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর অঙ্গীকার করা হয়েছে। উভয় পক্ষই সন্ত্রাসবাদের সকল প্রকার ও প্রকাশের নিন্দা পুনর্ব্যক্ত করেছে, এবং ইস্যুটির রাজনীতিকরণের সমালোচনা করেছে। পাকিস্তান জম্মু ও কাশ্মীরকেও তুলে ধরেছে এবং বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে চিনা পক্ষকে আপডেট করেছে। চিন রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদ, প্রাসঙ্গিক নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব এবং দ্বিপাক্ষিক চুক্তিগুলো বিবেচনায় রেখে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে।
রাজনৈতিক ও কৌশলগতভাবে পাকিস্তান চিনের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে, যেমন শি বলেছেন, চিন ‘কৌশলগত ও দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিকোণ থেকে’ পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলেছে, যার অর্থ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর পাকিস্তানের বর্তমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার তেমন কোনও প্রভাব পড়ার কথা নয়। পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরও ভাল সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলেও চিনের সঙ্গে তার সম্পর্ক এখনকার মতোই থাকবে।
এই ভাষ্যটি প্রথমে ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’–এ প্রকাশিত হয়েছিল।
মতামত লেখকের নিজস্ব।