• ডিসেম্বর 07 2022

অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের বিদেশ নীতি সংক্রান্ত সমীক্ষায় তরুণ উত্তরদাতারা ভারতের বিদেশ নীতি এবং বিকশিত বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে একটি পরিশীলিত ধারণার প্রমাণ দিয়েছেন।

চিন,বিদেশনীতি,ভারত-চিন যুদ্ধ,ইন্দো-প্যাসিফিক,পোখরান নিউক্লিয়ার টেস্ট

ভারত যেহেতু স্বাধীনতার ৭৫তম বছর পূর্ণ করছে, এ কথা বোঝা অত্যন্ত জরুরি যে, ভারতের যুবসম্প্রদায় অর্থাৎ দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৬০% বিদেশনীতি এবং বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্বন্ধে কী মনোভাব পোষণ করেন। নীতিনির্ধারক এবং জনসাধারণের মধ্যের ব্যবধানটি পূরণ করতে অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ও আর এফ) ১৯টি শহর এবং ১০টি ভাষায় ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে ৫০০০ জন ভারতীয়ের উপর দি ও আর এফ ফরেন পলিসি সার্ভে ২০২২ পরিচালনা করেছে। সামগ্রিক ভাবে, উত্তরদাতাদের অধিকাংশই ভারতের বিদেশনীতিকে সমর্থন করেছেন, এবং তাদের ৭৭% এটিকে ভাল অথবা খুব ভাল হিসেবে মতদান করেছেন।

চিনের হুমকির কথা সবার কাছেই স্পষ্ট। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, পোখরান পারমাণবিক পরীক্ষা, ভারত-চিন যুদ্ধ এবং গলওয়ান উপত্যকার সংঘর্ষ ভারতের বিদেশনীতির মূল বাঁকবদল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। চিনের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাতকে ভারতের বৃহত্তম আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিদেশনীতির চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হয়েছে (৮৪%), যা পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘর্ষের (৮২%) চ্যালেঞ্জটিকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। বড় সংখ্যক উত্তরদাতা চিন এবং তার উত্থানকে ভারতীয় সীমান্তের জন্য হুমকি হিসেবে দেখেছেন এবং ভবিষ্যতের অংশীদার হিসেবে চিনকে তাঁদের পছন্দের সর্বনিম্ন (২৪%) স্থানে রেখেছে্ন।

পোখরান পারমাণবিক পরীক্ষা, ভারত-চিন যুদ্ধ এবং গলওয়ান উপত্যকার সংঘর্ষ ভারতের বিদেশনীতির মূল বাঁকবদল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

যুবসম্প্রদায় ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ব্যাপারে আশাবাদ প্রদর্শন করেছেন। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে স্বাধীনতার পর থেকে দ্বিতীয় সর্বাধিক বিশ্বস্ত অংশীদার হিসেবে দেখা হয়েছে, ৮৫% উত্তরদাতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আগামী ১০ বছরে ভারতের প্রধান অংশীদার দেশ হিসেবে বিবেচনা করেছে্ন; যেখানে আবার ৮৩% উত্তরদাতা এ বিষয়ে সহমত হয়েছেন যে, ভারতের উত্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হবে।

ভারতীয় স্বার্থ এ ধরনের ধারণার জন্য চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মার্কিন-চিন চাপানউতোর বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে ভারতীয় যুব সম্প্রদায় জোটনিরপেক্ষতা এবং নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করাকেই নির্বাচন করেছে্ন। কিন্তু ভারতীয় স্বার্থ ঝুঁকির সম্মুখীন হলে প্রতিক্রিয়া পরিবর্তিত হয়: ৭৩% বলেছেন যে, চিনকে প্রতিহত করার জন্য ভারতের উচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোট বাধা।

অনেক উত্তরদাতাই রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ সত্ত্বেও আশাবাদের ইঙ্গিত দিয়েছে্ন; ৪৩% উত্তরদাতা রাশিয়াকে স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে মনে করেছেন। উত্তরদাতারা উভয় দেশের মধ্যে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে সমর্থন জুগিয়েছে্ন। এর পাশাপাশি অনেকেই বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন সম্পর্কে নিজেদের সচেতনতা প্রদর্শন করেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অপ্রত্যাশিত রকমের সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তরদাতা এ ব্যাপারে সম্মত হয়েছে্ন যে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক সম্পর্ক সীমিত এবং একই সঙ্গে তাঁরা রুশ-চিন সম্পর্কের সশক্তকরণের প্রেক্ষিতে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছেন ও আশঙ্কা করেছে্ন যে, এর ফলে ভারত ও রাশিয়া একে অপরের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। আগামী ১০ বছরে ভারতের শীর্ষস্থানীয় অংশীদারের প্রসঙ্গে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়ার পরে রাশিয়া তৃতীয় স্থান দখল করেছে।

একটি বহুমুখী অনিশ্চয়তাপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থায় আঞ্চলিক শক্তিগুলির গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোয়াড প্রসঙ্গ উত্তরদাতাদের মধ্যে সীমিত উৎসাহের উদ্রেক করলেও অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানের মতো কিছু সদস্য দেশ উল্লেখযোগ্য রকমের ইতিবাচক মনোভাবের সঞ্চার করেছে। জাপানকে ভবিষ্যতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইন্দো-প্যাসিফিক অংশীদার হিসেবে দেখা হয়েছে, তার পরে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া।

নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় ভারতের ক্রমবর্ধমান অংশীদারিত্ব সত্ত্বেও, যুব সম্প্রদায় ভারতের প্রতিবেশকে কৌশলগত গুরুত্ব প্রদান করেছেন। উত্তরদাতারা বিশ্বাস করে্ন যে, ভারত তার প্রতিবেশকে দক্ষতার সঙ্গে সংজ্ঞায়িত করেছে এবং নিরাপত্তা, বাণিজ্য এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি যথার্থ বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করেছে। যদিও এই ফলাফলগুলি পুরো অঞ্চল জুড়ে রাজনৈতিক ব্যস্ততা, পরিকাঠামো এবং সংযোগ প্রকল্পগুলি বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার দিকেই ইঙ্গিত দেয়। পাশাপাশি এ কথাও তুলে ধরে যে, যুব সম্প্রদায় চান ভারত দক্ষিণ এশিয়া এবং ভারত মহাসাগর অঞ্চলে তার বিনিয়োগ অব্যাহত রাখুক।

সন্ত্রাসবাদ (৮৬%) এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাত ভারতের বিদেশনীতির সামনে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। মূলত, চিন, পাকিস্তান এবং তালিবান শাসিত আফগানিস্তানকে (৩৩%) বাদ দিয়ে, যুব সম্প্রদায় অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের উপর ভরসা রেখেছে্ন এবং ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের নিরিখে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেছেন। উত্তরদাতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ (৫৮%) এই ইঙ্গিতই দিয়েছে্ন যে, পাকিস্তানের সঙ্গে জড়িত না থাকার ফলে ভারতের বিদেশনীতি আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য উপকৃত হয়েছে। আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের পরবর্তী সময়ে উত্তরদাতারা (৬৮%) ভারতের আফগানিস্তান নীতিকে সমর্থন করেছেন এবং ভারতীয় যুব সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ (৩৭%) ভারতীয় স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য তালিবানের সঙ্গে সীমিত সম্পৃক্ততাকে সমর্থন করেছে্ন।

উত্তরদাতারা বিশ্বাস করে যে, ভারত তার প্রতিবেশকে দক্ষতার সঙ্গে সংজ্ঞায়িত করেছে এবং নিরাপত্তা, বাণিজ্য এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি যথার্থ বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করেছে।

অপ্রথাগত এবং আন্তর্দেশীয় হুমকিগুলিকে উল্লেখযোগ্য বলে মনে করা হয়েছে। অতিমারিকে (৮৯%) চিন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাতের চেয়েও ভারতের বিদেশনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। একই ভাবে, সংখ্যাগরিষ্ঠরা এ বিষয়ে একমত যে, অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পৃক্ততার পছন্দের পন্থা হওয়া উচিত বহুপাক্ষিকতাই। বহুপাক্ষিক সংস্কারের জন্য একটি শক্তিশালী স্পৃহা দেখা গিয়েছে – উত্তরদাতাদের ৯১% রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী আসনের জন্য ভারতের দাবিকে সমর্থন জুগিয়েছেন। সামগ্রিক ভাবে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে ভারতের বিদেশনীতি সম্পর্কে একটি ইতিবাচক ধারণা দেখা গিয়েছে। উত্তরদাতারা ভারতের বিদেশনীতি এবং বিকশিত বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে একটি পরিশীলিত ধারণার প্রমাণ দিয়েছে্ন।

একটি দেশের বিদেশনীতি প্রায়শই জনপ্রিয় ধারণা দ্বারা চালিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের মতো দেশে, যুব সম্প্রদায় বিদেশনীতির পদ্ধতি নিয়ে জাতীয় কথোপকথনের উপর একটি নিষ্পত্তিমূলক প্রভাব ফেলেছেন এবং আলোচ্যসূচির বিষয়গুলিকেও প্রভাবিত করছে্ন। সুতরাং এ কথা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে, গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হওয়ার দরুন তরুণ প্রজন্ম কীভাবে বিদেশনীতির লক্ষ্যগুলিকে দেখেন, যা ভারতের মতো একটি নবীন দেশের জন্য এক জটিল প্রক্রিয়া। এটি এবং সমীক্ষার ভবিষ্যৎ সংস্করণগুলি নীতিনির্ধারক এবং জনসাধারণের মধ্যে ব্যবধান কমাতে সক্ষম হবে।


এই প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশিত হয় হিন্দুস্থান টাইমস-এ।

মতামত লেখকের নিজস্ব।

Comments are closed.

সম্পাদক